আমরা একটা দারুণ সময়ে বসবাস করছি এখন। ইটারনেট আর সামাজিক যােগাযােগমাধ্যমগুলাে এই সময়ে আমাদের জীবনযাপনের অনুষঙ্গ হয়ে গেছে। আমার মনে হয়, এটার একটা জাদুকরী প্রভাব পড়েছে সমাজে। সাধারণ মানুষ তাদের কথা ও কাজকে খুব সহজে বহু মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারছে। একটা সময় ছিল যখন নিজের লেখা কিংবা নিজের সৃষ্টিকর্মকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে হলে তাকে একটা বই প্রকাশ করতে হতাে কিংবা তার কাজগুলােকে পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করতে হতাে। সবার পক্ষে সেটা সম্ভব হতাে না। এখন এই প্রকাশের কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। অন্তর্জালে ব্লগে অথবা সামাজিক যােগাযােগমাধ্যমগুলাের নানা গ্রুপে তারা সৃষ্টিশীল কাজগুলাে সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারছে। সামাজিক মাধ্যমগুলােতে তাকালে আমরা তাই অসাধারণ সৃষ্টিশীল কিছু কাজ দেখতে পাই।
কিন্তু প্রদীপের তলায় যেমন অন্ধকার থাকে, তেমনি সামাজিক যােগাযােগমাধ্যমের একটা খারাপ দিকও আছে। মানুষ তাদের মনের অন্ধকার দিকগুলােও অবলীলায় এখানে প্রকাশ করে ফেলছে। কুরুচিপূর্ণ পােস্ট, মতামত কিংবা মন্তব্য চোখে পড়ে অহরহ। এসব পােস্টে কিংবা মন্তব্যে যে যার মতাে উল্টোপাল্টা যুক্তি দিচ্ছে। ভুলভাল তথ্য ছড়াচ্ছে। ‘জাল খবর’ বা ফেইক নিউজের পরিমাণও বাড়ছে।
আমার মনে হয়, এখন একটা ভালাে সময় যৌক্তিকভাবে সচেতন হওয়ার। যে যা বলছে তা মেনে না নিয়ে একবার ভেবে দেখার। যুক্তির নিক্তিতে একবার পরখ করে নেওয়া যে তাদের কথায় কিংবা যুক্তিতে ফাঁক রয়ে গেল কি না। যারা পাঠক, তাদের যেমন জানা দরকার, তেমনি জানা দরকার যারা বক্তা তাদেরও।
আসলে সেই চিন্তা থেকেই এই বইটি লেখা।
সামাজিক যােগাযােগমাধ্যমগুলােতে মানুষ আমাকে চেনে গণিতের ভিডিও আর লেখালেখির কারণে। গণিত আমার অত্যন্ত প্রিয়, আমার প্রথম ভালােবাসা। আর গণিতের যেখানে ভিত্তি, সেটা হচ্ছে যুক্তি। যুক্তি ব্যাপারটা ভালাে করে না জানলে গণিত-বিজ্ঞানের চর্চা ঠিকমতাে করা যায় না। যুক্তি নিয়ে যেখানে আলােচনা করা হয়, তাকে বলে যুক্তিবিদ্যা, যেটা বহু প্রাচীন একটা বিজ্ঞান। এই বইয়ে যুক্তিবিদ্যার নানা রকম পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করা যেত। কিন্তু আমি ইচ্ছা করেই সেগুলাে এড়ানাের চেষ্টা করেছি, যেন এ বইটা একাডেমিক পাঠ্যবইয়ের মতাে না হয়ে যায়। আমি চেয়েছি বইটি যেন সাধারণ মানুষের কাছে আরও বেশি করে পৌঁছে যেতে পারে। আমার আশা, তাহলে মানুষ চলতে-ফিরতে কথা বলার সময় কুযুক্তি কিংবা যুক্তির ভ্রান্তিগুলাে নিয়ে সতর্ক থাকবে।
ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, যুক্তি ব্যাপারটাকে সবচেয়ে ভালাে করে বােঝা যায় তখনই, যখন এর দুর্বলতাগুলাে বােঝা যায়। যখন এর ভ্রান্তিগুলােকে অনুভব করা যায়। এই বইটিতে যুক্তির নানা রকম ভ্রান্তি (ইংরেজিতে বললে logical fallacy) নিয়ে আলােচনা করেছি।
এই বইটি যে আমি পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারছি, তার জন্য কিছু মানুষের কাছে আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। এখন থেকে দুই বছর আগে বুয়েটের সিনিয়র বড় ভাই নিউটন এম এ হাকিম আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন লজিক্যাল ফ্যালাসি নিয়ে একসঙ্গে একটি বই প্রকাশ করার। আমরা একসঙ্গে শুরু করেছিলাম, কিন্তু পরে সময়ের অভাবে কাজটা আর এগিয়ে নিতে পারিনি। এ বছর কিছুটা সময় পেয়ে নিজেই কাজটা করে ফেলেছি। পরে সময় পেলে একসঙ্গে আরেকটু বড় পরিসরে এই বিষয়টা নিয়ে লেখালেখির ইচ্ছে আছে। নিউটন ভাইয়ের জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা রইল। এ ছাড়া কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি টেন মিনিট স্কুলের আয়মান সাদিকের কাছে। আমরা দুজনে একসঙ্গে একটা লাইভ অনুষ্ঠান করেছিলাম। সেখানে যুক্তির বিভ্রান্তিগুলাে নিয়ে কথা বলার সুযােগ হয়েছিল। এই বইটি এ বছর শুরু করার পেছনে ওই অনুষ্ঠানটি একটা বড় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
আদর্শকে ধন্যবাদ, নিয়মিত তাগাদা দিয়ে যাওয়ার জন্য। বন্ধু মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়কে ধন্যবাদ বইটির নাম নিয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য। আমার সহমানুষ ফিরােজা বহ্নি এবং আত্মজা বিনীতা বর্ণমালাকে ধন্যবাদ, তাদের ভাগের একটু সময় এই বইয়ের পেছনে ব্যয় করতে দেওয়ার জন্য। শুধু লেখালেখি না, আমার সানন্দে বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় প্রেরণা, সবচেয়ে বড় অবলম্বন তােমরা!
বইটি পড়ে মানুষের যুক্তিবােধ আরেকটু শাণিত হােক, যুক্তির ভ্রান্তিগুলাের ব্যাপারে মানুষ সচেতন হােক, লেখক হিসেবে এটুকুই চাওয়া।