সুজান ফ্লেচার বৃটিশ লেখিকা, জন্ম ১৯৭৯ সালে বার্মিংহামে, পড়াশোনা করেছেন ইউনিভার্সিটি অফ ইয়র্ক এবং ইউনিভার্সিটি অফ ইস্ট অ্যাংলিয়াতে। প্রথম উপন্যাস হিসেবে তাঁর ‘ইভ গ্রীন’ ২০০৪ সালে হুইটব্রেড ফার্স্ট নভেল পুরস্কার পায়, ২০০৫ সালে পায় বেটী ট্রাস্ক পুরস্কার এবং দ্য অথার্স ক্লাব বেস্ট ফার্স্ট নভেল পুরস্কার। তাঁর প্রকাশিত বইগুলি হচ্ছে- ‘ইভ গ্রীন’ (২০০৪), ‘অয়েস্টারক্যাচারস’(২০০৭), ‘কোরাগ/দ্য উইচ লাইট’ (২০১০), ‘দ্য সিলভার ডার্ক সী’(২০১২)। আমি ‘ইভ গ্রীন’ বইটি হাতে পাই ২০০৬ এ, এবং শেষ করবার অনেক আগেই এই বইটি আমার অসম্ভব প্রিয় বইয়ের তালিকায় স্থায়ী আসন নেয়, আমাদের প্রিয় গল্পগুলি অনিবার্যভাবে ভালবাসার, জীবন গুঁড়িয়ে দেয়া ভালবাসার, বহুদিন ভেবেছি, এই বইটা আমার মাতৃভাষায় থাকবে না তাই কি হয়! তারপর একদিন অনুবাদ করতে শুরু করেছি নিজেই।
অদ্ভূত এক অকালপ্রয়াত মায়ের কাছ থেকে ইভাঞ্জেলীন চলে আসে পুরনো গীর্জাগন্ধী ধুলোভরা একখানা বাড়িতে, ওয়েলসে তার নানাবাড়িতে, সেখানকার ফার্মে উদ্গ্রীব প্রাণীদের ভাপমেশা শ্বাসের সুকোমল গন্ধ শুঁকে, কর্মব্যস্ত নানীর পেটের একচিলতে মন্ডাকার মেদ দেখতে দেখতে, নানার সাথে চিনিভরা মালাই চা খেতে খেতে, খামারবাড়ি আর মালখানার ভিতরবাইরে লুকোচুরি খেলতে খেলতে শৈশব কাটাতে থাকে সে। সে কেবল বুঝতে পারে, তার আইরিশ বাবাকে নিয়ে গ্রামে একটা কানাঘুষা আছে (অনেককাল আগে কোনো এক গ্রীষ্মে এই আইরিশ যুবক উত্তর ওয়েলসের এই গ্রামে আসে- নির্মল দেখনহাসি তার মুখে, অথচ নিয়ম ভাঙতে সদাপ্রস্তুত), সে বুঝতে পারে তার পরমা সুন্দরী মা কুমারী অবস্থায় প্রবল প্রেমে পড়েছিল এই যাযাবর মনের মানুষটির, লোকটা কাউকে না জানিয়ে যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেছে একদিন- ইভাঞ্জেলীনের মা বুকের ভিতর পেটের ভিতর স্বর্ণকমলের চিহ্নের মতন বহন করেছে ভালবাসার স্মারক, একটি ছোট্ট মেয়ে- ইভাঞ্জেলীন গ্রীন। ইভ গ্রীন। একসময় তার মায়ের ক্লান্ত হৃদয় আর পারে নাই।
ইভকে চলে আসতে হয় নানীর কাছে। সেখানে বদ্ধ সমাজে উন্মুক্ত প্রান্তরে বহুকিছু ঘটে যা ইভ তার শিশুর দৃষ্টি নিয়ে দ্যাখে, ধাঁধার জটিলতা খুলতে চায়, পারে না, গ্রাম থেকে একটি রূপসী অল্পবয়েসী মেয়ে হারিয়ে যায় চিরতরে। পিডোফিলের হাতছানি টের পায় ইভ। আজীবন ইভ সেই মর্মপীড়া থেকে বেরুতে পারে না। পুরো লেখাটি ইভাঞ্জেলীনের জবানিতে দুইভাবে লেখা, একটি আটবছরের ইভ, আরেকটি পুর্নগর্ভা ইভ, বারেবারে তাদের জগত একাকার হয়ে যেতে থাকে, অথচ যেন একখানা অশ্রুর পর্দা দিয়ে দুই জগত পৃথক করে রাখা। দুই জগতই অজানা বিষাদ-প্রিয় হারাবার শোক-অনুতাপ-গোপন গ্লানিতে টনটনে। একটিতে শিশু ইভাঞ্জেলীনের সামনে শ্রাদ্ধবাসরের পতাকার মতন পতপতিয়ে ওঠে পাহাড়ি বাতাস- তার অজান্তে পাহাড়ে আছড়ে পড়ে মৃত মায়ের শবভস্ম; আরেকটিতে গর্ভবতী ইভাঞ্জেলীন এমনকি কবরখানার অতুল নির্জনতায় আর লাইলাক রঙা অন্ধকারে আবিষ্কার করে পাখির পেড়ে যাওয়া নীল ডিমের মতন কিছু লুকিয়ে থাকা স্মৃতি। জন্মান্তরগুলি ঘটে দ্রুত, যাত্রাগুলি রীতিমত নিশি পাওয়া মানুষের যাত্রার মতন, শিশুর চোখ অকপট এবং নিষ্ঠুর, সে সকল কদর্যকে খোঁজে; যুবতীর চোখ সপ্রেম ও সংবেদনশীল, সে কেবল খোঁজে স্বস্তি। আটবছুরে ইভের স্বরে ফ্লেচার অনায়াসে শুনিয়েছেন শিশুর বিস্ময়ে উপলব্ধি করা জীবনের দর্শন (আমি ভাবতাম বিয়ের ফলে এই বুঝি হয়, তুমি আরেকজনের খারাপটাকে ডিঙিয়ে ভালটুকুকেই শুধু দেখতে পাও। যেমন করে আমি জানালায় তুষারপাত দেখবার সময় কখনো জানালার কাচে পাখির গু কিংবা ছ্যাতলা দেখতে পেতাম না।), শিশুর প্রগাঢ় অনভিজ্ঞতাকে ফ্লেচার একটি ভাষা হিসেবেই ব্যবহার করেছেন, ভার্জিনিয়া উলফ তিরিশের দশকে ‘ফ্লাশ’ এ যেমন একটি ককার স্প্যানিয়েলের দৃষ্টি দিয়ে দেখেছিলেন এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং এর জীবনকে।