অক্ষরজ্ঞানহীন দরিদ্র এক সন্তান তার মায়ের মৃত্যুর পর ভাবলেন মাকে তো আর দেখতে পাব না। তাহলে শেষ স্মৃতি হিসেবে মায়ের একটা ছবি তোলা যাক। যখন মাকে মনে পড়বে, ছবিটা দেখবে সে। হোক সে এখন মৃতদেহ, তবুও সে তো মা। কিন্তু গ্রামের মানুষের কাছে মৃতদেহের ছবি তোলা ছিল বিশাল বড় এক অপরাধ। এই অপরাধের জন্য তাকে একঘরে করা হয়। এমনকি তার মায়ের জানাজায় কেউ শামিল পর্যন্ত হয়নি। অবশেষে সদ্য মাকে হারানো সেই সন্তান কিছু অমুসল্লি মানুষ নিয়ে জানাজা ছাড়াই তার মায়ের মৃতদেহ কবরে রাখেন। বলছি আরজ আলী
মাতুব্বর-এর কথা। আরজ আলী মাতুব্বর হলেন বাংলাদেশের একজন লেখক ও দার্শনিক; সর্বোপরি একজন বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব। তিনি বলেন, ‘মানুষের মনে জিজ্ঞাসার অন্ত নাই। কোনো না কোনো বিষয়ে কোনো না কোনো রকমের জিজ্ঞাসা প্রত্যেকের মনেই আছে, যেমন আপনার, তেমন আমার।’
মায়ের মৃত্যুর পর তার ছবি তোলার অপরাধে সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাতের পর তিনি বড্ড বেশি অবাক হন। তিনি সত্যসন্ধানী হয়ে ওঠেন। তার মনে অনেক প্রশ্ন জাগে। যার উত্তর রয়েছে বিভিন্ন বইপত্রে। কিন্তু তিনি লিখতে-পড়তে জানতেন না। নিজের চেষ্টায় তিনি লেখাপড়া শিখলেন। বিশাল দূরত্ব পাড়ি দিয়ে তিনি নিয়মিত বরিশাল বিএম কলেজের লাইব্রেরিতে যাতায়াত করতেন। সেখানে সারা দিন বইপত্র পড়তেন। বাংলাভাষায় লিখিত যেসব বই তখন নাগালে ছিল তার অধিকাংশ বই-ই তিনি তার জীবদ্দশায় পড়েছেন।
তিনি লিখতেন। কিন্তু সে লেখার ধরন ছিল ভিন্ন। তিনি নিজেকে প্রশ্ন করে করে লিখতেন এবং সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াতেন। বিশ্বের বহু দার্শনিকের মতো তারও প্রশ্ন ছিল- ‘আমি কে?’ শুধু দার্শনিকদের নয়, এই প্রশ্নটা সবার। সবাই নিজের কাছে জানতে চায় ‘আমি কে?’ এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি যে উত্তর দেন সেটাও এক প্রশ্ন বৈকি। তিনি বলেন- ‘‘মানুষের আমিত্ববোধ যত আদিম ও প্রবল, তত আর কিছুই নহে। আমি সুখী, আমি দুঃখী, আমি দেখিতেছি, আমি শুনিতেছি, আমি বাঁচিয়া আছি, আমি মরিব ইত্যাদি হাজার হাজার রূপে আমি আমাকে উপলব্ধি করিতেছি।’ কিন্তু যথার্থ ‘আমি’- এই রক্ত-মাংস-অস্থি-মেদ-মজ্জায় গঠিত দেহটিই কি ‘আমি’? তাহাই যদি হয়, তবে মৃত্যুর পরে যখন দেহের উপাদানসমূহ পচিয়া-গলিয়া অর্থাৎ রাসায়নিক পরিবর্তনে কতগুলি মৌলিক পদার্থে রূপান্তরিত হইবে, তখন কি আমার আমিত্ব থাকিবে না? যদি না-ই থাকে, তবে স্বর্গ-নরকের সুখ-দুঃখ ভোগ করিবে কে? নতুবা ‘আমি’ কি আত্মা? যদি তাহাই হয়, তবে আত্মাকে ‘আমি’ না বলিয়া ‘আমার’- ইহা বলা হয় কেন? যখন কেহ দাবি করে যে, দেহ আমার, প্রাণ আমার এবং মন আমার, তখন দাবিদারটি কে?’’
নানা মুনি নানা মত। পৃথিবীতে মোট ধর্মের সংখ্যা ৪৩০০ এর মত। প্রত্যেক ধর্মেই আছে সেই ধর্মই শ্রেষ্ঠ। সেই ধর্মের সৃষ্টিকর্তাই এক ও অদ্বিতীয়। সেই ধর্ম পালনকারীরাই স্বর্গে যাবে বাকিরা নরকে। যুগে যুগে এই ধর্মবিরোধ নিয়েই বড় বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধগুলো হয়েছে, এখনো হচ্ছে।এমনকি নিজের ধর্মের ভিতরও শ্রেনীবিভেদ। হিন্দুদের ব্রাক্ষণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র; মুসলিমদের শিয়া, সুন্নি; খ্রিস্টানদের ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট। এদের নিজেদের মধ্যে আবার মতবিভেদ, ভায়োলেন্স। এত বিভ্রান্তিকর ধর্মীয় মতবাদের কতটুকু সত্য আর কতটুকু মিথ্যা। এইসব নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর। এটা একটা অবশ্যই পাঠ্য বই।