কথায় আছে যে, "কুত্তার লেঙ্গুর কখনো সোজা হয় না"। উপন্যাসটার প্রধান চরিত্র 'আলি কেনান' ও সেইরকমই। যত পীর-ফকিরের তকমাই লাগান না কেন শেষ পর্যন্ত সে একজন রক্তমাংসে গড়া মানুষ, যার ভেতরে কামনা-বাসনা ঘাপটি মেরে বসে থাকে উত্তম সময় আর সুযোগের অপেক্ষায়। এত প্রবল আত্মশক্তি আর আত্মবিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও সব কিছু হারাতে হয়েছে তাকে। আমার কাছে মনে হয়েছে আলি কেনান নিজের ধ্বংসের রাস্তা নিজেই ঠিক করেছিল জাগতিক মোহ আর মানবিক কামনা-বাসনার বশবর্তী হয়ে।
আহমদ ছফার লেখায় কী যেন একটা আছে। যেটুকু সময় পড়া হয়, একদম মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়তে হয়। কিন্তু বন্ধ করে রেখে একবার উঠলেই আর কোন খোঁচাখুঁচি নেই, মোচড়ামুচড়ি নেই। যেন ও বই কখনো পড়িই নি! পরেরবার যখন ধরি আবারও সেই অনুভূতি, কোন জড়তা নেই, কোন আটকে যাওয়া নেই। শব্দের গাঁথুনি আর বিষয়বস্তুর জোরে হারিয়ে ফেলা নিজেকে, কিন্তু হাত থেকে রাখলেই আবার সেই অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার!
বইটায় আলী কেনানের অবস্থা আসলে জিক জ্যাকের মত। একবার ওঠে তো আরেকবার ধসে যায়। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেক্ষাপটের সাথে সমান্তরাল করে এগিয়েছে কাহিনী। চরিত্রটাকে লেখক বেশ শক্তিশালী, ধুর্ত, বাস্তববাদী, আত্মবিশ্বাসী হিসেবে স্থাপন করেছে। বইতে কেনানকে শেখ সাহেবের ভক্ত হিসেবে দেখানো হয়েছে। যখন শেখ সাহেবের উত্থান হয়, তখন কেনানেরও উত্থান, আর শেখ সাহেবের পতন হলে কেনানেরও পতন। এছাড়া তুলে ধরেছে মাজার নামক ধর্ম ব্যাবসার খুটিনাটি, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের এই অতিআবেগী, অতিসংবেদনশীল, বোকাসোকা বাংগালি জাতির মাথায় কাঠাল ভেঙে খায় যেসব মানুষ, তাদের চরিত্রের প্রতিনিধি! অথচ সেই কী না ছফার সাথে পড়ে যে পরিমাণ উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে গেলেন তা বলার ভাষা আমার নেই। কেউ একবার বলেছিলো "লাইফ ইজ অ্যা সাইন কার্ভ", আলী কেনানের জীবনী(!) পড়লে কথার সত্যতা আঁচ করা যায় বৈ কী!
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরকে নৌকাডুবি হইতে বাচাইয়া তাহার অতি আস্থাভাজনে পরিণত হয় কেনান। ঘটনাক্রমে একবছর পরই সেই গভর্নর তাহার পশ্চাৎদেশে লাত্থি মেরে বের করে দেয় অফিস থেকে। এরপর শুরু হয় তার জীবনের উত্থান-পতন। লঞ্চঘাটে একদিন ভিক্ষা চাইতে গিয়ে সে তার ভেতরের এক সুপ্ত ক্ষমতা আবিষ্কার করে। এরপর দরবেশ হিসেবে গোড়াপত্তন করে ফুলতলির মাঝারে, জুটে যায় হাজারো ভক্ত। আর তারপর…………বাকিটা ইতিহাস।
কী দুর্দান্ত সাহসই না ছিল এই লোকটার কলমের আগায়! মাজার ব্যবসা এবং ব্যবসায়ীদের স্বরূপ এই বইয়ের সিকিভাগও উন্মোচন করতে পারে, এমন লেখক কি একজনও এখনো আছে এ বাংলায়??